আব্দুল হামিদ মৌলভীবাজার জেলা প্রতি প্রতিনিধিঃ
মৌলভীবাজারে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় খাসিয়াপুঞ্জি (গ্রাম) রয়েছে। খাসিয়া জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রধান উৎস হচ্ছে পান চাষ। সুপারিগাছ জড়িয়ে পানগাছ বেড়ে ওঠে। খাসিয়াদের ইতিহাস ধরে রাখতে পুলিশ ও সরকারি লোকদের উপর মামলা হামলা মৌলভীবাজার
জেলার কমলগঞ্জ, কুলাউড়া সহ ৪ উপজেলার পাহাড়ী জনপদে ৪টি রেঞ্জের আওতায় ছিলো ২৩টি বাঁশমহাল। যা থেকে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতো। অথচ বনবিভাগের উদাসীনতা আর কালের বিবর্তণে বাঁশমহালগুলো আজ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সিংহ ভাগ কয়লার পাহাড় বাঁশমহাল অনেক কিছু রয়েছে খাসিয়াদের দখলে। যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তাও আজ বিলুপ্তির পথে। ফলে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য।
বনবিভাগ রেঞ্জের সূত্রে জানা যায়, সিলেট বনবিভাগের আওতায় মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ উপজেলার বিশাল বনভূমি জুড়ে ৪টি রেঞ্জের আওতায় ১৪টি বনবিটে ২৩টি বাঁশমহাল ছিলো। বনবিটগুলো আছে রেঞ্জ এবং এই রেঞ্জগুলোর সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য রয়েছে অতিরিক্ত বন সংরক্ষকের কার্যালয়। কিন্তু বিটের আওতায় অবস্থিত সিংহ ভাগ অন্নান্য প্রানিগুলি ও বাঁশমহাল উজাড় হয়ে গেছে। নেপথ্যে পাহাড়ী জনপদ জবর দখল করে উঠা খাসিয়া সম্পদ ও গারো সম্প্রদায়ের ৭৯টি পানপুঞ্জি।গঠিত হয়েছে সংগঠন।হাজারো বাসিন্দাদের পেটে গেয়েছে অধিকাংশ পাহাড়ী সম্পদ। বাঁশের জায়গা দখল করে নিয়েছে পান।আর সরকার বাঁশমহাল থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পেলেও সেই স্থানে জবরদখলে নেওয়া পান থেকে রাজস্ব রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হওয়ার কোন নজির নেই। বন বিভাগ এর সূত্র জানায়, কুলাউড়া রেঞ্জের গাজীপুর বনবিটের আওতায় পূর্ব ও
পশ্চিম গোগালীছড়া বাঁশ মহাল,ছোট কালাইগিরি বাঁশমহাল, মুরইছড়া বনবিটের আওতায় বড় বাঁশ মহাল, নলডরী বনবিটের আওতায় লবনছড়া বাঁশমহাল ও বেগুনছড়া বাঁশমহাল। কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রেঞ্জের আওতায় আদমপুর বনবিটের আওতায় লাউয়াছড়া বাঁশমহাল ও ডালয়াছড়া বাঁশ মহাল, কুরমা বনবিটের আওতায় কুরমাছড়া বাঁশ মহাল, চাম্পারায়ছড়া বাঁশ মহাল ও সোনারায়ছড়া বাঁশ মহাল, বাঘা ছড়া বনবিটের আওতায় বাঘাছড়া বাঁশ মহাল এবং কামারছড়া বনবিটের আওতায় সুনছড়া বাঁশ মহাল। বড়লেখা উপজেলার বড়লেখা রেঞ্জের অধীনে মাধবছড়া বনবিটের মাধবছড়া বাঁশমহাল, বড়লেখা বনবিটের আওতায় নিকুড়িছড়া বাঁশ মহাল ও সাতমাছড়া বাঁশ মহাল এবং সমনবাগ বনবিটের আওতায় লাটু ছড়া (ধলছড়া) বাঁশ মহাল। জুড়ী উপজেলাধীন জুড়ী রেঞ্জের অধীনে রাগনা বনবিটের আওতায় রাগনা ছড়া বাঁশ মহাল ও ধলাইছড়া বাঁশ মহাল, লাঠিটিলা বিটের আওতায় সুরমাছড়া বাঁশ মহাল ও হলম্পাছড়া বাঁশ মহাল, সাগরনাল বিটের আওতায় সাগরনাল বাঁশ মহাল এবং পুটিছড়া বনবিটের আওতায় পুটিছড়া বাঁশমহাল ছিলো।
বনবিভাগের তথ্যমতে, জুড়ী রেঞ্জের পুটিছড়া বাঁশ মহাল এবং কুলাউড়া রেঞ্জের পশ্চিম গোগালী ছড়া বাঁশহাল দুটি ছাড়া আর কোন বাঁশ মহাল চলমান নেই। জুড়ীর সুরমাছড়া বাঁশমহাল নিয়ে আদালতে মামলা চলছে।এতে কোন লাভ হচ্ছে না, জুড়ীর হলম্পাছড়া বাঁশ মহাল, বড়লেখা রেঞ্জের ৪টি, কুলাউড়া রেঞ্জের ৫টি ও কমলগঞ্জ রাজকান্দি রেঞ্জের ৬টি বাঁশ মহালসহ মোট ১৬টি বাঁশমহাল ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে কুলাউড়া বনবিভাগ সুত্র জানায়, কুলাউড়া রেঞ্জের আওতাধীন ছোট কালাইগিরি ২০০২ সনে ৩২ লাখ ১০ হাজার টাকা লিজ দেওয়া হয়। বড় কালাইগিরি ২০০৭ সালে লিজ দেওয়া ৭৩ লাখ ৪২ হাজার টাকায়, লবনছড়া বাঁশ মহাল সর্বশেষ ২০০৪ সালে লিজ দেওয়া হয় এবং বেগুন ছড়া বাঁশ মহাল সর্বশেষ ২০১০ সালে ৫৮ লাখ ৪০ সহ অধিক টাকায় লিজ দেওয়া হয়। এরপর থেকে বাঁশ মহালগুলো আর লিজের আওতায় আসেনি। এসব বাঁশ মহালে বাঁশের পরিবর্তে এখন পানজুম স্থান করে নিয়েছে। প্রায় ৯০ ভাগ বাঁশ মহাল খাসিয়াদের দখলে। শুধু কুলাউড়া রেঞ্জের বাঁশমহাল থেকে সরকার বছরে ২ থেকে আড়াই কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পেতো সরকার। সেখানে গত এক যুগ ধরে কোন টাকাই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হচ্ছে না। এভাবে ৪টি রেঞ্জের গড় হিসাবে সরকার প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। বাঁশমহাল বিলুপ্তির কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, দিন দিন সরকারের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে খাসিয়া ও গারোদের পানপুঞ্জির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে বাঁশের উপর। শুধু বাঁশ আর গাছ নয় ও জীববৈচিত্র্যর উপরও এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। আগে এসব সংরক্ষিত বনে বাঘ, হরিণ, বানর, বন্য হাতি, বনমোরগের দেখা মিলতো অহরহ। কিন্তু এখন এদের অস্থিত্ব নেই বললেই চলে। পান লাগানোর জন্য বাঁশ আর গাছ কেটে সাবাড় করা হয়েছে। ফলে খাবারের সন্ধানে শেয়াল আর বানর হানা দিচ্ছে লোকালয়ে। বস্তির মানুষের লড়াই করে ওরা নিজের খাবারের সংস্থান করতে পারলেও খাসিয়াদের কাছে হার মেনে ছাড়ছে বন। জুড়ী উপজেলার মতে, ২০০০ সাল বা সমসাময়িক কালে ৪টি রেঞ্জের আওতায় কমপক্ষে দেড় হাজারেরও বেশি ছিলেন মহালদার। যারা বাঁশ মহাল নিলামে অংশ নিতেন। আর এখন দেড়শ মহালদার খোঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। আগে একটি বাঁশের দাম ছিলো ৩-৪ টাকা এখন সেই বাঁশ ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ এখন বাঁশ নেই। আগে যে বাঁশ মহাল ৬০-৭০ লাখ বিক্রি হতো, এখন যদি সেই মহাল থাকতো কমপক্ষে ১০-১২ কোটি টাকা বিক্রি হতো। সরেজমিনে দেখা যায়, গহীন পাহাড়ি এলাকায় এসব বাঁশ মহাল থাকায় সেখানে খাসিয়া ব্যাতিত সাধারনের চলাচল একেবারেই নেই বললে চলে। যার কারনে খাসিয়ারা নির্বিঘে প্রথমে বাঁশ কাটে। সেই কাটা বাঁশ শুকিয়ে যাবার পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে বাঁশ সমুলে ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর ৬ মাস থেকে এক বছর পর সেই স্থানে খাসিয়ারা পানের চারা রোপন করে। আর এভাবে বাঁশ ও গাছ মহাল পানজুমে পরিনত হয়।
Leave a Reply