রিয়াজ রহমান:
কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক সোসাইটি
ভাটি বাংলার সিংহ পুরুষ বললে যে নামটি সর্ব প্রথম চোখের সামনে ভেসে উঠে তিনি রাজনীতির বটবৃক্ষ স্বাধীন বাংলার প্রথম পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রয়াত জাতীয় নেতা আবদুস সামাদ আজাদ। ৬৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের বেশী সময় তিনি ছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিধি। সরকারে ছিলেন মাত্র আট বছর। এর পরও মানুষের সুখ-দুঃখ ও দেশের কল্যানে তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। ব্রিটিশ বিরাধী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসা আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সকল আন্দোলনের অগ্রপথিক। আজ ২৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার তাঁর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল ৮৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
আজীবন আব্দুস সামাদ আজাদ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো রাজপথ, কখনো জেল জীবন কখনো আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মিছিলের অগ্রভাগে। তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক মান ছিল আকাশ ছোয়া। তিনি ছিলেন রাজনীতির এক বটবৃক্ষ। াএই বটবৃক্ষের বিশাল ছায়ায় সবাই একত্রিত হতেন। তাঁর সান্নিধ্য পেতে অনেকেই আসতেন সময়ে-অসময়ে, দুর্যোগে-সংকটে। তাই ব্যক্তি রাজনীতিক থেকে তিনি পরিণত হয়েছিলেন এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে।
বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের এক চরম ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরেছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। জাতির জনক হত্যাকান্ড,জেল হত্যাকান্ড,সামরিক শাসনের পেশীশক্তি যখন আওয়ামী লীগকে ভীষণ দুর্বল করে তুলেছিল, সে সময়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার সাহাস দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সামাদ আজাদ। তাঁর অসম ধৈর্য, প্রজ্ঞা,সাহসিকতা, বিচক্ষণতার ফলেই ১৯৭৮-৭৯ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ প্রাণ পেতে শুরু করেছিল পুরো মাত্রায়। সে সময় জনসাধারণকে যে সাহসটি তাঁর বক্তব্যে মধ্য দিয়েছিলেন, তাহল আওয়ামী লীগকে কেউ ষড়যন্ত্র করে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার বিচার বাংলাদেশে হবেই। তাঁর সে স্বপ্ন পূরন হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ শ্রদ্ধার সাথেই তাঁর এই বক্তব্য স্মরণ করবেন।
আবদুস সামাদ আজাদ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামে ও তাঁর অবদান নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল। এছাড়াও প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন।
১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার প্রত্যান্ত অঞ্চল চিলাউড়া হলদিপুর ইউনিয়নের ভুরাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গণমানুষের এই নেতা। ছাত্র অবস্থাতেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হন। পরে অবিভক্ত আসামের মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৪৮ সালে আবদুস সামাদ আজাদ সিলেট এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু সরকারবিরোধী রাজনীতির কারণে তাঁকে মাস্টার্স শেষ পর্বের পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনের কর্মচারিরা তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেন। ছাত্রনেতা হিসেবে আবদুস সামাদ আজাদও সেই আন্দোলনে সমর্থন দেন এবং যুক্ত হন। এই অপরাধে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ওই সময় একই অপরাধে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৬ জনকে আর্থিক জরিমানা, ৬ জনকে চার বছরের জন্য বহিষ্কার এবং ১৫ জনকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন বিলুপ্ত হয়ে গেলে আবদুস সামাদ আজাদ নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৪৯-৫০ সালে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগ দেন আবদুস সামাদ আজাদ।
বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় মহান ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনে আবদুস সামাদ আজাদ সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন। সিলেটে এবং ঢাকায় আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ঢাকায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।
ভাষা আন্দোলনে আবদুস সামাদ আজাদ সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন
ভাষা আন্দোলনে আবদুস সামাদ আজাদ সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন।
আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর আবদুস সামাদ আজাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তাঁর মাথার মূল্য ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ সময় তিনি আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু এক সময় গ্রেপ্তার হন। প্রায় চার বছর কারাগারে থাকার পর ১৯৬২ সালে মুক্তি পান। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আবদুস সামাদ আজাদ অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। যুদ্বকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকার গঠনেও ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মুজিবনগর সরকারে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত। এছাড়া তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সদস্যও ছিলেন।
যুদ্ধে বিজয় লাভের পর ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর আবদুস সামাদ আজাদ মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি গঠিত মন্ত্রিসভায় তাঁকে পুনরায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির যাত্রা শুরু হয়। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ক্ষেত্রে তিনি তাঁর ক্যারিশমাটিক সাফল্য দেখিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এ সময় আবদুস সামাদ আজাদকে এক সপ্তাহ গৃহবন্দি করে রাখার পর ২২ আগস্ট তাঁকে গ্রেপ্তার করে জাতীয় চার নেতার সঙ্গে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় সামরিক আদালতে আবদুস সামাদ আজাদের বিচার করা হয় এবং বিচারে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। চার বছর কারাভোগের পর ১৯৭৯ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন।
ু
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যার পর আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নানা চড়াই-উতরাই পেরুতে হয়। সে এক দুর্যোগময় সময়! বিশেষ করে নেতৃত্ব-শূণ্যতার কারণে দলটি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সভানেত্রী হিসেবে দলের হাল ধরলে সংকট কাটে।
১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে আবদুস সামাদ আজাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তিনি প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এই সময়কালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনীতিতে তিনি ব্যাপক সাফল্য বয়ে আনেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। তখনকার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আই কে গুজরাল ছিলেন তাঁর বন্ধু। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক গঙ্গাচুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে আবদুস সামাদ আজাদ অনন্য ভূমিকা পালন করেন। কূটনৈতিক তৎপরতার বাইরে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত সকল পক্ষকে ঐক্যমতে এনে সেদিন ঐতিহাসিক এই চুক্তিটি করে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৯৭ সালে বাংলা-ভারত পানিবণ্টন চুক্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিকা পালন করেন। একই বছর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি তাঁর সাফল্যের জয়যাত্রায় মাইল ফলক হয়ে আছে।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে তিনি সপ্তমবারের মতো জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলার এই জাতীয় নেতা ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
Leave a Reply