আন্তর্জাতিক ডেস্ক :: বিএনপির রাজনীতিতে খালেদা জিয়া কি ধীরে ধীরে নেপথ্যে চলে যাচ্ছেন—এমন প্রশ্ন এখনই ওঠার কথা নয়। কিন্তু উঠছে এ কারণে যে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারেক রহমান। অন্যদিকে কারামুক্ত চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশানের ‘ফিরোজা’য় চিকিৎসা নিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, অ’সুস্থ হলেও তিনি ‘ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে টিকে থাকবেন।
একই সঙ্গে চেয়ারম্যান ও ভা’রপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থাকার ঘটনায় দলের ভেতরে ও বাইরে গুঞ্জন থামানো যাচ্ছে না। কারণ তারেক নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় দল গোছানোর জন্য তৎপরতা শুরু করেছেন। তিনি চাইছেন, স্থায়ী কমিটিসহ সবাই তাঁর পক্ষে কথা বলুক। এ জন্য পছন্দের লোকদের তিনি ধীরে ধীরে পদায়নের চেষ্টাও চালাচ্ছেন, যা দলের সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি সব স্তরে দৃশ্যমান হচ্ছে। অন্যদিকে দলের বড় একটি অংশও আবার এ কারণে শঙ্কিত হয়ে ভাবছেন তারেক পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারলে বিএনপিতে তাদের ভবিষ্যৎ নেই। তারা কেউ বা নীরব, আবার কেউ বা খালেদা জিয়াকে দলে সক্রিয় করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের অনেকের আরেকটি ভাবনা হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এখনো তারেকের তুলনায় খালেদা জিয়াই বেশি গ্রহণযোগ্য। ফলে তাঁকে সামনে নিয়েই অন্তত আরেকটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষপাতী তারা।
এদিকে গত তিনটি নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফল ঘরে তুলতে না পারার কারণ ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় সুধীসমাজের মধ্যেও একই ধরনের আলোচনা নতুন করে ছড়িয়েছে। দলের একটি অংশের পাশাপাশি সুধীসমাজের কেউ বলছেন, দলকে সামনের দিকে টেনে নেওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা আর খালেদা জিয়ার নেই। সাজা স্থগিত করে নির্বাহী আদেশে কারামুক্তির কারণে তাঁর পক্ষে রাজনীতিতে সরব হওয়াও সম্ভব নয় বলে তাঁরা মনে করেন। তাই তাঁরা তারেক রহমানের নেতৃত্বেই দল পরিচালনায় পক্ষপাতী। আবার কারো মতে, বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় তারেক রহমানকে সামনে নিয়ে এগোলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম’র্থন পাওয়া কঠিন হবে। তাঁদের মতে, দেশের অভ্যন্তরে ‘ক্ষমতার বিকল্প বিভিন্ন কেন্দ্র’ বলে পরিচিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাও তারেক রহমানকে সম’র্থন করছে না। ফলে অ’সুস্থ হলেও খালেদা জিয়াই এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তির সবচেয়ে বড় প্রতীক বলে তাঁরা মনে করেন।
তবে তারেক সম’র্থকরা যু’ক্তি দিচ্ছেন, বিদেশিদের সঙ্গে সমঝোতা করতেও তারেক রহমানকেই লাগবে। কারণ দলের অন্য কারো সঙ্গে সমঝোতা হলেও তা কাজে লাগবে না। তা ছাড়া গত তিনটি নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দল পরিচালিত হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। এই অংশের আরেকটি অ’ভিযোগ হলো, সিনিয়র বেশির ভাগ নেতা তারেকের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য কাজ করেন না, বরং আড়ালে তাঁর সমালোচনা করেন। তাই তারেক রহমানকে সামনে নিয়েই তাঁরা দল পরিচালনার পক্ষপাতী।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বাইরে বিএনপির দু-একজন সিনিয়র নেতাকে দলের হাল ধ’রার পরাম’র্শ দিয়েছিল বলে জানা যায়। এমন সমঝোতা বা প্রস্তাবে ক্ষমতায় যাওয়া অথবা শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে সংসদে যাওয়ার মতো আসন দেওয়ার প্রস্তাব ছিল বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা যায়। কিন্তু এক-এগারোর কথা বিবেচনায় রেখে সিনিয়র নেতারা খালেদা ও তারেকের বি’রুদ্ধে অবস্থান নিতে রাজি না হওয়ায় নির্বাচনী ফলাফলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে বলে বিএনপিতে আলোচনা আছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান মনে করেন, অ’সুস্থ হলেও খালেদা জিয়াই এখন পর্যন্ত বিএনপির ঐক্যের প্রতীক। ফলে মাইনাস খালেদা জিয়া বিএনপির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তিনি না থাকলে বিএনপি ভেঙে যাওয়াও অসম্ভব নয়। প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘তারেক রহমান র’ক্তের উত্তরাধিকার, সেটি ঠিক আছে; কিন্তু এর আগে তাঁর বি’রুদ্ধে ওঠা অ’ভিযোগগুলো তিনি খণ্ডন করতে পারেননি। ফলে বিএনপিকে অখণ্ড রাখতে হলে তারেকের মে’য়ে ব্যারিস্টার জাই’মা রহমানকে এখনই রাজনীতিতে নিয়ে আসা উচিত। দাদি খালেদা জিয়ার কাছ থেকে সে রাজনীতি শিখতে পারে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান—এই পরিবারবৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে রাজনীতি বা ক্ষমতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে বিএনপি ভবিষ্যতে না-ও পৌঁছতে পারে। তিনি বলেন, ক্ষমতায় থাকতে তারেক সম’র্থকদের ভূমিকায় সে’নাবাহিনী ক্ষুব্ধ ছিল। সেই অবস্থার আজও পরিবর্তন হয়নি। তা ছাড়া এই পরিবারতন্ত্র চলতে থাকলে একসময় বিএনপির সিনিয়র নেতারাও রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। সুধীসমাজও বিএনপিকে গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে ভা’রতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেছেন। তাই পরিবারতন্ত্র পাকাপোক্ত না করে খালেদা জিয়ারও দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা শুরু করা উচিত, বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স’ম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুম’দারের মতে, খালেদা জিয়া অ’সুস্থ থাকার কারণে এই মুহূর্তে হয়তো তারেক রহমানকে বিএনপির প্রয়োজন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সুধীসমাজ ও জনগণের কাছে খালেদা জিয়ার অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তাঁকে বাদ দিয়ে কিছুই হবে না। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শক্তিশালী প্রা’ণী ডাইনোসরও বিলুপ্ত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের এই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিও আগামী দিনে বদলাবে। তাই পারিবারিক মালিকানা বাদ দিয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের সামনে এনে দলের মধ্যেই খালেদা জিয়ার গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের মতে, তারেক রহমানের কম বয়স এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা বিএনপির অ্যাসেট। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার অ্যাসেট হচ্ছে তাঁর ইমেজ, গ্রহণযোগ্যতা এবং দেশ পরিচালনার অ’ভিজ্ঞতা। বিএনপিকে এই দুই অ্যাসেটের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। তবে দল পরিচালনায় অবশ্যই খালেদা জিয়ার অ’ভিভাবকত্ব থাকতে হবে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একটি দু’র্নীতি মা’মলায় খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়ার দিনই এক সংবাদ বি’জ্ঞপ্তিতে ‘তারেক রহমানকে দলের ভা’রপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ ঘোষণা করে বিএনপি।
Leave a Reply